নজরুল_ও_ফজিলাতুন্নেসার_প্রেম
নজরুল_ও_ফজিলাতুন্নেসার_প্রেম
আবদুল মান্নান সৈয়দ
--------------------------
১৯২৮ সালে নজরুল ইসলাম ঢাকায় তিনজন নারীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। ‘ঘনিষ্ঠ’ কথাটি ব্যবহার করছি ইচ্ছা করেই। কারণ, এই তিনজন নারীই নজরুল সাহিত্যে তাঁদের – মূলত কবিতায় ও গানে – চিহ্ন রেখে যান। এঁরা হচ্ছেন : মিস্ ফজিলতুন্নেসা (১৮৯৯-১৯৭৭), উমা মৈত্র এবং রানু সোম (প্রতিভা বসু, ১৯১৫-২০০৬)।
মিস্ ফজিলতুন্নেসা (১৮৯৯-১৯৭৭) এই নামেই বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি, যদিও উত্তরকালে বিবাহ করেন, ও সন্তানের জননী হন। টাঙ্গাইলের করটিয়ায় জন্ম। পিতা : ওয়াহেদ আলি খাঁ। বরাবর মেধাবী ছাত্রী। ঢাকার ইডেন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। অঙ্কে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে গণিতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে বিলেত যান। বিলেতেই লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী খানবাহাদুর আহছানউল্লাহর পুত্র শামসুজ্জোহার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, পরে বিবাহ। ১৯৩৫এ কলকাতার বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকার ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে মৃত্যু। তাঁর লেখা কিছু গল্প, প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র সেকালের পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত আছে।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে নজরুল ঢাকায় এসে সেবার প্রায় তিন সপ্তাহ কাল ছিলেন। তিনি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি পূর্বাহ্নে ঢাকা ত্যাগ করেন।’ কাজী মোতাহার হোসেনের (১৮৯৭-১৯৮১) সঙ্গে নজরুলের আলাপ হয়েছিল আগেই। নজরুল ঢাকায় এসে প্রথম উঠেছিলেন আবুল হুসেনের (১৮৯৬-১৯৩৮) বাসভবনে। সম্মেলন শেষে কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একডেমীর ভিতরের সামনের বাড়িটা) একটি কক্ষে। নজরুল হাত দেখতে জানতেন। মোতাহার হোসেনই নজরুলকে দেওয়ানবাজারে ফজিলতুন্নেসার গৃহে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফজিলতুন্নেসা ‘কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ’ করেছিলেন। ‘আমার বন্ধু নজরুল, তাঁর গান’ শীর্ষক স্মৃতিরচনায় কাজী মোতাহার হোসেন প্রায় এক অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। একদিন রাতে নজরুল বর্ধমান হাউসের কক্ষ থেকে উধাও হয়েছিলেন, এবং পরদিন দেখা গেল মিস ফজিলতুন্নেসার গলার মটরমালার হারটি ছিন্ন। কাজী মোতাহার হোসেনই মালিটোলার সোনারুর দোকান থেকে ছিন্ন মটরমালাটি জোড়া দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
নজরুল যে মিস ফজিলতুন্নেসার প্রেমে পড়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার পর স্টিমার থেকেই যে-পত্রধারার সূচনা হয়েছিল কাজী মোতাহার হোসেনের উদ্দেশে, তার সবগুলি রক্ষিত হয়নি। এসবের উদ্ধারকর্তা সৈয়দ আলী আশরাফ নজরুল-জীবনে প্রেমের এক অধ্যায় গ্রন্থের প্রবেশকে লিখেছিলেন : ‘এই চিঠিগুলো ছাড়া আরো কয়েকটি চিঠি কাজী সাহেবের বাড়ির খোলা শেলফে ছিল। সেগুলো কে বা কারা যখন নিয়েছেন তা জানি না। এগুলোও গুম হয়ে যাবে ভেবে আমি চিঠিগুলো উদ্ধার করি এবং রক্ষা করি।
কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা যে ক-টি চিঠি পাওয়া গেছে, সে-সবের রচনার স্থান ও কাল এরকম:
১। ‘পদ্মা’। ২৪-২-২৮। সন্ধ্যা। ঠঁষঃঁৎব (স্টিমার)।
২। কৃষ্ণনগর। ২৫-২-২৮। বিকেল।
৩। কৃষ্ণনগর। ১-৩-২৮। বিকেল।
৪। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলিকাতা। ৮-৩-২৮। সন্ধ্যা।
৫। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। ১০-৩-২৮ রাত্রি ২টা।
৬। ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। ৩১-৩-২৮।
৭। ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। বিষুৎবার। তারিখহীন।
৮। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলিকাতা। সকাল। তারিখহীন।
মিস ফজিলতুন্নেসাকে লেখা একটিমাত্র চিঠি পাওয়া গেছে। তারিখহীন পত্রটির রচনাস্থান ও কাল : ‘১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। শনিবার, রাত্রি বারোটা’। এই চিঠির একটি অনুচ্ছেদ এরকম : আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানি। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সঞ্চিতা আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কি সম্মান করিব?’ এর থেকেই নজরুলের মনোভাব পরিষ্কার হয়ে যায়।
বার্ষিক সওগাত-এর জন্যে মিস ফজিলতুন্নেসা ‘শুধু দুদিনের দেখা’ নামে একটি গল্প পাঠিয়েছিলেন। বার্ষিক শিখা-র দ্বিতীয় বর্ষে (১৩৩৫) ‘নারীজীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’ নামে ফজিলতুন্নেসার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সওগাতে আরো প্রবন্ধ বেরিয়েছিল : ‘মুসলিম নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ (অগ্রহায়ণ ১৩৩৪), ‘মুসলিম নারীর মুক্তি’ (ভাদ্র ১৩৩৬) প্রভৃতি। সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের (১৮৮৮-১৯৯৪) চেষ্টায় উচ্চশিক্ষার জন্যে বিলেতে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন মিস ফজিলতুন্নেসা। সাপ্তাহিক সওগাতে বিলেত থেকে পাঠানো মিস ফজিলতুন্নেসার কয়েকটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। একটি মিসেস আর.এস.হোসেন অর্থাৎ বেগম রোকেয়া। (১৮৮০-১৯৩২)-কে লেখা (সাপ্তাহিক সওগাত, ২২শে মার্চ ১৯২৯, ৮ চৈত্র ১৩৩৫, ১ : ৪৩)অর্থাৎ নজরুল ইসলাম, কবি শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), কবি মঈনুদ্দীন (১৯০৯-৮১), ডা.মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬), মিসেস এম, রহমান (১৯৮৫-১৯২৬), শামসুর নাহার মাহমুদ (১৯০৮-৬৪), মিস ফজিলতুন্নেসা প্রমুখ অনুজ কবি-লেখকদের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার সৌহার্দ ছিল।
মিস ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশে নজরুল বেশ কয়েকটি কবিতা-গান লিখেছিলেন। চক্রবাক (১৯২৯) কবিতাগ্রন্থের অন্তত তিনটি কবিতা মনে হয় তাঁর উদ্দেশে রচিত : ‘এ মোর অহংকার’, ‘তুমি মোরে ভুলিয়াছ’ এবং ‘বর্ষা -বিদায়’। ১৯২৮ সালে সওসাত অফিসে মিস ফজিলতুন্নেসাকে যে-বিদায়-সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল, তাতে নজরুল তাঁর স্বরচিত গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন :
জাগিলে পারুল কি গো সাত ভাই চম্পা ডাকে।
উদিলে চন্দ্রলেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।
চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ার পুরে
ফোটে ফুল নিত্য যথায়
জীবনের ফুল্ল শাখে।
আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুটে ঐ বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে ভুলে
এপারের মর্ত-কূলে
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে।
সওগাত-সম্পাদক লিখেছেন, ‘ফজিলতুন্নেসার বিদায়-সংবর্ধনা-দিনে নজরুলকে খুব বিষণ্ন দেখা গিয়েছিল। তিনি ভিতরের একটি ঘরে চুর করে বসেছিলেন। মনে হলো ফজিলতুন্নেসার বিদায়ে তিনি খুব ব্যথিত। পরে তিনি সভাস্থলে এসে উপরোক্ত গানটি গেয়ে শোনান। আরো কিছু বিরহাত্মকগানে ফজিলতুন্নেসার নেপথ্য উপস্থিতি আছে। ফজিলতুন্নেসার বিবাহ-সংবাদ শুনে কবি লেখেন, ‘বাদল বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি’। নজরুলের গানের ও কবিতার মতন কবি জসীমউদ্দীনও (১৯০৩-৭৬) মিস ফজিলতুন্নেসার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ‘বিদায়-অভিনন্দন (মিস ফজিলতুন্নেসার বিলাতে যাওয়া উপলক্ষে)’ নামে জসীমউদ্দীনের এই কবিতাটি সওগাত পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘকবিতাটির শেষাংশ এরকম :
হে প্রভাতী তারা,
তুমি যে ঊষারে ডেকে আঁধারের কূরে আত্মহারা,
হয়তো সে রক্ত-নারী হাসিবে যখন
তাহার লোহুর গাঙে তোমার জীবনখানি হতে পারে কভু প্রয়োজন।
তবু হেরো, হে অগ্রচারিণী,
তোমার পশ্চাৎপট ধরি আসে যেন দলে দলে নারী।
অনন্ত বরণী
তাদের রক্তিম ডালে, হে প্রভাতী, তব রশ্মিখানি
জ্বলিছে সোনার শীষে জানি যেন জানি।
সওগাত অফিসে মিস ফজিলতুন্নেসাকে বিদায়-সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজনের বিরোধিতা করেছিল মোহাম্মদী গোষ্ঠী। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখেছেন, ‘এতে মোহাম্মদী ও তার রক্ষণশীল দল কোলাহল আরম্ভ করেন। মুসলমান মেয়েকে বিলাতে পাঠানো তাঁরা ইসলামবিরোধী কাজ বলে প্রচার করতে লাগলেন; কিন্তু সওগাত দল একে নারীজাগরণের উত্তম পন্থা বলে গ্রহণ করলেন’। (সওগাত-যুগে নরুজল ইসলাম)।
নজরুল ও ফজিলতুন্নেসার প্রেমের বিষয়টি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে।
কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘নজরুল ভেবেছিল, ফজিলতকে সে প্রায় জয় করে নিয়েছে বধূরূপে। কিন্তু সে ফজিলতের টাইপ বা মানসিক ধাঁচ বুঝতে না পারায় অনেক মর্মান্তিক কষ্ট ভোগ করেছে। নিঃসন্দেহে প্রত্যাখ্যাত হয়। নজরুল ইতিমধ্যেই দোজবরে বলে চিহ্নিত হয়েছে। এর পরেও ফজিলত তাকে তেজবরে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে পারে? এ চিন্তাটা মোটেই নজরুলের মনে উদয় হয়নি।’
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখেছেন, ‘ফজিলতুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তাঁর দূরদর্শিতাও ছিল যথেষ্ট। নজরুলের প্রেম প্রত্যাখ্যান না করলে একটা অনর্থের সৃষ্টি হবে এবং তাঁর ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বিনষ্ট হবে। তাই তিনি নজরুলকে একটি কড়া চিঠি দেন এবং এটাই বোধহয় নজরুলকে লেখা ফজিলতুন্নেসার একমাত্র চিঠি। চিঠি পেয়ে নজরুল মনে দারুণ আঘাত পান এবং বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখেন : ‘বড্ড শক পেয়েছি কাল ওঁর চিঠি পড়ে। শরীর মন দুই অসুস্থ বলে হয়তো এতটা লাগল। … তবে ঐ এক চিঠি পেয়েই যতটা বুঝেছি আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না।’
আকবরউদ্দীন লিখেছেন, ‘নজরুলের কথাবার্তায় আমার মনে হয়েছিল ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বাঁধন-হারার মনের একটা রুদ্ধদ্বার খুলে গিয়েছিল। … নজরুলের প্রতি ফজিলতুন্নেসার আকর্ষণ কম ছিল না। নজরুলের নিজের মুখে শোনা একটা রাত্রির ঘটনা থেকে বুঝেছিলাম ফজিলতুুন্েনসার আকর্ষণ ছিল জৈবিক এবং তার দাবি পূরণ করার শক্তি নজরুলের ছিল না। এই দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবের মিলন সম্ভব নয়। সুতরাং কে কাকে প্রত্যাহার করল, বিচার করা কঠিন ও অসমীচীন।
কাজী মোতাহার হোসেন, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, আকবরউদ্দীন – এঁরা সবাই ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আগে থেকেই ছিল মিস ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুতা। ১লা মার্চ ১৯২৮ সালে নজরুল মোতাহার হোসেনকে এক পত্রে লিখেছিলেন, “তুমি এক জায়গায় লিখেছ মনে হয় যেন একটু দুঃখ পাচ্ছি -কিন্তু কী মধুর সেই দুঃখ”! এ দুঃখ কি আমাকে পারিয়ে? আমায় বলতে তোমার সংকোচ হবে না নিশ্চয়। ‘সেতু’ই কি শেষে জলে পড়ে গেল? কাজী মোতাহার হোসেন ফজিলতুন্নেসা – সংপৃক্ত স্মৃতিচারণায় নিজে থেকেই ফজিলতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘আমি ফজিলতকে চেয়েছি এবং পেয়েছি অতি পবিত্র বান্ধবীরূপে। ফজিলতও আমাকে পেয়েছে অনাবিল বান্ধবরূপে। আমরা আমাদের বান্ধব-বান্ধবী সম্পর্ক পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখেছি। মুশকিল হলো : নজরুল ছিলেন অসাধারণ একজন সৃষ্টিশীল কবি ও লেখক।ফলে জীবনের যে-সব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তিনি গিয়েছেন, তার সবই স্বাক্ষরিত আছে তাঁর রচনায়। যেমন আছে পৃথিবীর সব প্রকৃত লেখক-শিল্পীর জীবনে ও সাহিত্যে। প্রেম মানেই বিবাহে পরিণতির কথা ভেবেছিলেন নজরুল-কাজী মোতাহার হোসেনের এই মন্তব্যের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করতে পারছি না।
নজরুল-জীবনীকার আজহারউদ্দীন খান যে-ভাষায় ও ভঙ্গিতে লিখেছেন তা এরকম : ‘আজ একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে নজরুলের প্রতি ফজিলতুন্নেসার কোনো আকর্ষণই ছিল না, কারণ নজরুল ছিলেন বিবাহিত, পুত্র পরিবার নিয়ে রীতিমতো সংসারী মানুষ। এবং ‘হতাশ প্রেমিকের মতো ‘দেবদাস’ সিনেমা ও ঐদিন সন্ধ্যার শো-তে দেখেছেন চিঠিতে তারও উল্লেখ আছে। প্রেমের ষোলোকলা নজরুলের দিক থেকে পূর্ণ হয়েছে কিন্তু রাধা নাচল না।
এ কী কোনো জীবনীলেখকের ভাষা? আর এরকম সরলীকরণ?
সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা, বেগম-সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ‘মিস ফজিলতুন্নেসা ছিলেন সুন্দর, শ্যামল, স্লিম, খুবই স্নিগ্ধ। ফজিলতুন্নেসাকে ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতেই বিলেত যাবার আগে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় বাবা আর কবি আবদুল কাদিরকে মোহাম্মদী গ্রুপ মেরেই ফেলতে চেয়েছিল। সেই ছোট ঘরের কথা বলেছিলাম না? সেখানে একদিন হঠাৎ দেখে ফেলেছিলাম – নজরুল বসে আছেন চেয়ারে। ফজিলতুন্নেসা বসে আছেন মেঝেতে। চুল এলানো। মা-র হাতের থাপ্পড় খেয়েছিলাম সেদিন। ওই ঘরে যেতে মা বারণ করেছিলেন আমাকে।
আমাদের বিশ্বাস নজরুল – ফজিলতুন্নেসার প্রেম একটি পর্যায় পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তারপর একপক্ষের – এক্ষেত্রে মিস ফজিলতুন্নেসার – সরে যাওয়ায় তা নির্বাপিত হয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্য কাজী নজরুল ইসলামের হাত থেকে পেল একগুচ্ছ অনির্বচনীয় গান ও কবিতা।
PSC মেম্বার শ্রদ্ধেয় Qoumaran_Nessa_Khanom স্যারের দেয়াল থেকে!
আবদুল মান্নান সৈয়দ
--------------------------
১৯২৮ সালে নজরুল ইসলাম ঢাকায় তিনজন নারীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। ‘ঘনিষ্ঠ’ কথাটি ব্যবহার করছি ইচ্ছা করেই। কারণ, এই তিনজন নারীই নজরুল সাহিত্যে তাঁদের – মূলত কবিতায় ও গানে – চিহ্ন রেখে যান। এঁরা হচ্ছেন : মিস্ ফজিলতুন্নেসা (১৮৯৯-১৯৭৭), উমা মৈত্র এবং রানু সোম (প্রতিভা বসু, ১৯১৫-২০০৬)।
মিস্ ফজিলতুন্নেসা (১৮৯৯-১৯৭৭) এই নামেই বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি, যদিও উত্তরকালে বিবাহ করেন, ও সন্তানের জননী হন। টাঙ্গাইলের করটিয়ায় জন্ম। পিতা : ওয়াহেদ আলি খাঁ। বরাবর মেধাবী ছাত্রী। ঢাকার ইডেন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। অঙ্কে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে গণিতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে বিলেত যান। বিলেতেই লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী খানবাহাদুর আহছানউল্লাহর পুত্র শামসুজ্জোহার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, পরে বিবাহ। ১৯৩৫এ কলকাতার বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকার ইডেন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে মৃত্যু। তাঁর লেখা কিছু গল্প, প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র সেকালের পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত আছে।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে নজরুল ঢাকায় এসে সেবার প্রায় তিন সপ্তাহ কাল ছিলেন। তিনি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি পূর্বাহ্নে ঢাকা ত্যাগ করেন।’ কাজী মোতাহার হোসেনের (১৮৯৭-১৯৮১) সঙ্গে নজরুলের আলাপ হয়েছিল আগেই। নজরুল ঢাকায় এসে প্রথম উঠেছিলেন আবুল হুসেনের (১৮৯৬-১৯৩৮) বাসভবনে। সম্মেলন শেষে কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একডেমীর ভিতরের সামনের বাড়িটা) একটি কক্ষে। নজরুল হাত দেখতে জানতেন। মোতাহার হোসেনই নজরুলকে দেওয়ানবাজারে ফজিলতুন্নেসার গৃহে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফজিলতুন্নেসা ‘কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ’ করেছিলেন। ‘আমার বন্ধু নজরুল, তাঁর গান’ শীর্ষক স্মৃতিরচনায় কাজী মোতাহার হোসেন প্রায় এক অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। একদিন রাতে নজরুল বর্ধমান হাউসের কক্ষ থেকে উধাও হয়েছিলেন, এবং পরদিন দেখা গেল মিস ফজিলতুন্নেসার গলার মটরমালার হারটি ছিন্ন। কাজী মোতাহার হোসেনই মালিটোলার সোনারুর দোকান থেকে ছিন্ন মটরমালাটি জোড়া দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
নজরুল যে মিস ফজিলতুন্নেসার প্রেমে পড়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার পর স্টিমার থেকেই যে-পত্রধারার সূচনা হয়েছিল কাজী মোতাহার হোসেনের উদ্দেশে, তার সবগুলি রক্ষিত হয়নি। এসবের উদ্ধারকর্তা সৈয়দ আলী আশরাফ নজরুল-জীবনে প্রেমের এক অধ্যায় গ্রন্থের প্রবেশকে লিখেছিলেন : ‘এই চিঠিগুলো ছাড়া আরো কয়েকটি চিঠি কাজী সাহেবের বাড়ির খোলা শেলফে ছিল। সেগুলো কে বা কারা যখন নিয়েছেন তা জানি না। এগুলোও গুম হয়ে যাবে ভেবে আমি চিঠিগুলো উদ্ধার করি এবং রক্ষা করি।
কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা যে ক-টি চিঠি পাওয়া গেছে, সে-সবের রচনার স্থান ও কাল এরকম:
১। ‘পদ্মা’। ২৪-২-২৮। সন্ধ্যা। ঠঁষঃঁৎব (স্টিমার)।
২। কৃষ্ণনগর। ২৫-২-২৮। বিকেল।
৩। কৃষ্ণনগর। ১-৩-২৮। বিকেল।
৪। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলিকাতা। ৮-৩-২৮। সন্ধ্যা।
৫। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। ১০-৩-২৮ রাত্রি ২টা।
৬। ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। ৩১-৩-২৮।
৭। ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। বিষুৎবার। তারিখহীন।
৮। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলিকাতা। সকাল। তারিখহীন।
মিস ফজিলতুন্নেসাকে লেখা একটিমাত্র চিঠি পাওয়া গেছে। তারিখহীন পত্রটির রচনাস্থান ও কাল : ‘১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, সওগাত অফিস, কলিকাতা। শনিবার, রাত্রি বারোটা’। এই চিঠির একটি অনুচ্ছেদ এরকম : আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানি। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সঞ্চিতা আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কি সম্মান করিব?’ এর থেকেই নজরুলের মনোভাব পরিষ্কার হয়ে যায়।
বার্ষিক সওগাত-এর জন্যে মিস ফজিলতুন্নেসা ‘শুধু দুদিনের দেখা’ নামে একটি গল্প পাঠিয়েছিলেন। বার্ষিক শিখা-র দ্বিতীয় বর্ষে (১৩৩৫) ‘নারীজীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’ নামে ফজিলতুন্নেসার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সওগাতে আরো প্রবন্ধ বেরিয়েছিল : ‘মুসলিম নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ (অগ্রহায়ণ ১৩৩৪), ‘মুসলিম নারীর মুক্তি’ (ভাদ্র ১৩৩৬) প্রভৃতি। সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের (১৮৮৮-১৯৯৪) চেষ্টায় উচ্চশিক্ষার জন্যে বিলেতে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন মিস ফজিলতুন্নেসা। সাপ্তাহিক সওগাতে বিলেত থেকে পাঠানো মিস ফজিলতুন্নেসার কয়েকটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। একটি মিসেস আর.এস.হোসেন অর্থাৎ বেগম রোকেয়া। (১৮৮০-১৯৩২)-কে লেখা (সাপ্তাহিক সওগাত, ২২শে মার্চ ১৯২৯, ৮ চৈত্র ১৩৩৫, ১ : ৪৩)অর্থাৎ নজরুল ইসলাম, কবি শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), কবি মঈনুদ্দীন (১৯০৯-৮১), ডা.মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬), মিসেস এম, রহমান (১৯৮৫-১৯২৬), শামসুর নাহার মাহমুদ (১৯০৮-৬৪), মিস ফজিলতুন্নেসা প্রমুখ অনুজ কবি-লেখকদের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার সৌহার্দ ছিল।
মিস ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশে নজরুল বেশ কয়েকটি কবিতা-গান লিখেছিলেন। চক্রবাক (১৯২৯) কবিতাগ্রন্থের অন্তত তিনটি কবিতা মনে হয় তাঁর উদ্দেশে রচিত : ‘এ মোর অহংকার’, ‘তুমি মোরে ভুলিয়াছ’ এবং ‘বর্ষা -বিদায়’। ১৯২৮ সালে সওসাত অফিসে মিস ফজিলতুন্নেসাকে যে-বিদায়-সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল, তাতে নজরুল তাঁর স্বরচিত গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন :
জাগিলে পারুল কি গো সাত ভাই চম্পা ডাকে।
উদিলে চন্দ্রলেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।
চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ার পুরে
ফোটে ফুল নিত্য যথায়
জীবনের ফুল্ল শাখে।
আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুটে ঐ বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে ভুলে
এপারের মর্ত-কূলে
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে।
সওগাত-সম্পাদক লিখেছেন, ‘ফজিলতুন্নেসার বিদায়-সংবর্ধনা-দিনে নজরুলকে খুব বিষণ্ন দেখা গিয়েছিল। তিনি ভিতরের একটি ঘরে চুর করে বসেছিলেন। মনে হলো ফজিলতুন্নেসার বিদায়ে তিনি খুব ব্যথিত। পরে তিনি সভাস্থলে এসে উপরোক্ত গানটি গেয়ে শোনান। আরো কিছু বিরহাত্মকগানে ফজিলতুন্নেসার নেপথ্য উপস্থিতি আছে। ফজিলতুন্নেসার বিবাহ-সংবাদ শুনে কবি লেখেন, ‘বাদল বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি’। নজরুলের গানের ও কবিতার মতন কবি জসীমউদ্দীনও (১৯০৩-৭৬) মিস ফজিলতুন্নেসার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ‘বিদায়-অভিনন্দন (মিস ফজিলতুন্নেসার বিলাতে যাওয়া উপলক্ষে)’ নামে জসীমউদ্দীনের এই কবিতাটি সওগাত পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘকবিতাটির শেষাংশ এরকম :
হে প্রভাতী তারা,
তুমি যে ঊষারে ডেকে আঁধারের কূরে আত্মহারা,
হয়তো সে রক্ত-নারী হাসিবে যখন
তাহার লোহুর গাঙে তোমার জীবনখানি হতে পারে কভু প্রয়োজন।
তবু হেরো, হে অগ্রচারিণী,
তোমার পশ্চাৎপট ধরি আসে যেন দলে দলে নারী।
অনন্ত বরণী
তাদের রক্তিম ডালে, হে প্রভাতী, তব রশ্মিখানি
জ্বলিছে সোনার শীষে জানি যেন জানি।
সওগাত অফিসে মিস ফজিলতুন্নেসাকে বিদায়-সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজনের বিরোধিতা করেছিল মোহাম্মদী গোষ্ঠী। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখেছেন, ‘এতে মোহাম্মদী ও তার রক্ষণশীল দল কোলাহল আরম্ভ করেন। মুসলমান মেয়েকে বিলাতে পাঠানো তাঁরা ইসলামবিরোধী কাজ বলে প্রচার করতে লাগলেন; কিন্তু সওগাত দল একে নারীজাগরণের উত্তম পন্থা বলে গ্রহণ করলেন’। (সওগাত-যুগে নরুজল ইসলাম)।
নজরুল ও ফজিলতুন্নেসার প্রেমের বিষয়টি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে।
কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘নজরুল ভেবেছিল, ফজিলতকে সে প্রায় জয় করে নিয়েছে বধূরূপে। কিন্তু সে ফজিলতের টাইপ বা মানসিক ধাঁচ বুঝতে না পারায় অনেক মর্মান্তিক কষ্ট ভোগ করেছে। নিঃসন্দেহে প্রত্যাখ্যাত হয়। নজরুল ইতিমধ্যেই দোজবরে বলে চিহ্নিত হয়েছে। এর পরেও ফজিলত তাকে তেজবরে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে পারে? এ চিন্তাটা মোটেই নজরুলের মনে উদয় হয়নি।’
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখেছেন, ‘ফজিলতুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তাঁর দূরদর্শিতাও ছিল যথেষ্ট। নজরুলের প্রেম প্রত্যাখ্যান না করলে একটা অনর্থের সৃষ্টি হবে এবং তাঁর ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বিনষ্ট হবে। তাই তিনি নজরুলকে একটি কড়া চিঠি দেন এবং এটাই বোধহয় নজরুলকে লেখা ফজিলতুন্নেসার একমাত্র চিঠি। চিঠি পেয়ে নজরুল মনে দারুণ আঘাত পান এবং বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখেন : ‘বড্ড শক পেয়েছি কাল ওঁর চিঠি পড়ে। শরীর মন দুই অসুস্থ বলে হয়তো এতটা লাগল। … তবে ঐ এক চিঠি পেয়েই যতটা বুঝেছি আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না।’
আকবরউদ্দীন লিখেছেন, ‘নজরুলের কথাবার্তায় আমার মনে হয়েছিল ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বাঁধন-হারার মনের একটা রুদ্ধদ্বার খুলে গিয়েছিল। … নজরুলের প্রতি ফজিলতুন্নেসার আকর্ষণ কম ছিল না। নজরুলের নিজের মুখে শোনা একটা রাত্রির ঘটনা থেকে বুঝেছিলাম ফজিলতুুন্েনসার আকর্ষণ ছিল জৈবিক এবং তার দাবি পূরণ করার শক্তি নজরুলের ছিল না। এই দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবের মিলন সম্ভব নয়। সুতরাং কে কাকে প্রত্যাহার করল, বিচার করা কঠিন ও অসমীচীন।
কাজী মোতাহার হোসেন, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, আকবরউদ্দীন – এঁরা সবাই ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আগে থেকেই ছিল মিস ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুতা। ১লা মার্চ ১৯২৮ সালে নজরুল মোতাহার হোসেনকে এক পত্রে লিখেছিলেন, “তুমি এক জায়গায় লিখেছ মনে হয় যেন একটু দুঃখ পাচ্ছি -কিন্তু কী মধুর সেই দুঃখ”! এ দুঃখ কি আমাকে পারিয়ে? আমায় বলতে তোমার সংকোচ হবে না নিশ্চয়। ‘সেতু’ই কি শেষে জলে পড়ে গেল? কাজী মোতাহার হোসেন ফজিলতুন্নেসা – সংপৃক্ত স্মৃতিচারণায় নিজে থেকেই ফজিলতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘আমি ফজিলতকে চেয়েছি এবং পেয়েছি অতি পবিত্র বান্ধবীরূপে। ফজিলতও আমাকে পেয়েছে অনাবিল বান্ধবরূপে। আমরা আমাদের বান্ধব-বান্ধবী সম্পর্ক পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখেছি। মুশকিল হলো : নজরুল ছিলেন অসাধারণ একজন সৃষ্টিশীল কবি ও লেখক।ফলে জীবনের যে-সব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তিনি গিয়েছেন, তার সবই স্বাক্ষরিত আছে তাঁর রচনায়। যেমন আছে পৃথিবীর সব প্রকৃত লেখক-শিল্পীর জীবনে ও সাহিত্যে। প্রেম মানেই বিবাহে পরিণতির কথা ভেবেছিলেন নজরুল-কাজী মোতাহার হোসেনের এই মন্তব্যের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করতে পারছি না।
নজরুল-জীবনীকার আজহারউদ্দীন খান যে-ভাষায় ও ভঙ্গিতে লিখেছেন তা এরকম : ‘আজ একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে নজরুলের প্রতি ফজিলতুন্নেসার কোনো আকর্ষণই ছিল না, কারণ নজরুল ছিলেন বিবাহিত, পুত্র পরিবার নিয়ে রীতিমতো সংসারী মানুষ। এবং ‘হতাশ প্রেমিকের মতো ‘দেবদাস’ সিনেমা ও ঐদিন সন্ধ্যার শো-তে দেখেছেন চিঠিতে তারও উল্লেখ আছে। প্রেমের ষোলোকলা নজরুলের দিক থেকে পূর্ণ হয়েছে কিন্তু রাধা নাচল না।
এ কী কোনো জীবনীলেখকের ভাষা? আর এরকম সরলীকরণ?
সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা, বেগম-সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ‘মিস ফজিলতুন্নেসা ছিলেন সুন্দর, শ্যামল, স্লিম, খুবই স্নিগ্ধ। ফজিলতুন্নেসাকে ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতেই বিলেত যাবার আগে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় বাবা আর কবি আবদুল কাদিরকে মোহাম্মদী গ্রুপ মেরেই ফেলতে চেয়েছিল। সেই ছোট ঘরের কথা বলেছিলাম না? সেখানে একদিন হঠাৎ দেখে ফেলেছিলাম – নজরুল বসে আছেন চেয়ারে। ফজিলতুন্নেসা বসে আছেন মেঝেতে। চুল এলানো। মা-র হাতের থাপ্পড় খেয়েছিলাম সেদিন। ওই ঘরে যেতে মা বারণ করেছিলেন আমাকে।
আমাদের বিশ্বাস নজরুল – ফজিলতুন্নেসার প্রেম একটি পর্যায় পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তারপর একপক্ষের – এক্ষেত্রে মিস ফজিলতুন্নেসার – সরে যাওয়ায় তা নির্বাপিত হয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্য কাজী নজরুল ইসলামের হাত থেকে পেল একগুচ্ছ অনির্বচনীয় গান ও কবিতা।
PSC মেম্বার শ্রদ্ধেয় Qoumaran_Nessa_Khanom স্যারের দেয়াল থেকে!
No comments