Search Here

রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন

দুই ভুবনের দুই বাসিন্দাঃ কবি ও বিজ্ঞানী -১ //
.
১৯২৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ জার্মানি আসছেন।
খবরটা শুনলেন বিজ্ঞান জগতের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি এলবার্ট আইনস্টাইন।
কথাটা শুনে কেমন একটা ভালো লাগা আসলো তাঁর মনে।
‘রবীন্দ্রনাথ আবার আসছেন তাঁর দেশে!’ বেশ রোমাঞ্চিত হলেন বিজ্ঞানী। এবার তিনি অবশ্যই কবিকে নিমন্ত্রণ করবেন। যেভাবেই হোক তাঁর সাথে দেখা করবেন।
কবি আগে একবার এসেছিলেন জার্মানিতে। সেটা পাঁচ বছর আগে। ১৯২১ সালে। তখনও এলবার্ট নোবেল পাননি। তিনি তখনও বিজ্ঞানী হিসেবে বেশ বিখ্যাত, তবু সেই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের মত অত বড় স্টার নন। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেবার কবির সাথে দেখা করতে পারেননি। তখন বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরেই নোবেল কমিটি পুরস্কারের জন্য এলবার্টের নাম ঘোষণা করলো। আর এখন তো বিজ্ঞান জগতের সবচেয়ে বড় তারকা তিনিই। এরিস্টোটল আর নিউটনের পর তাঁর মত খ্যাতি আর কোন বিজ্ঞানী পাননি। তবুও খ্যাতির মোহ তাঁকে উদ্ধত করেনি। তিনি বিনয়ী, তিনি গুণীর সম্মান দেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকর্ষণ একটুও কমেনি। এই বাংলা ভাষার কবিকে তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। তাঁর সান্নিধ্য এলাবার্টের জন্য এখনও বিশেষ কিছু।

এলবার্ট কখনও বাংলায় যাননি, ভারতেও না। ঐ অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর দেশের মানুষ এখনও তেমন কিছু জানে না। তাঁরা ছোটবেলা থেকে শুনেছেন, সেখানের মানুষ জাদু জানে – কালা জাদু, তাঁরা গলায় সাপ পেঁচিয়ে উলংগ হয়ে নাচে। সেই সাথে তাঁদের কিছু আধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনাও আছে, সেখানে একটা দার্শনিক সম্প্রদায় আছে বহুযুগ ধরে, তাঁরা অত্যন্ত জ্ঞানী। তাদের বলা হয় ঋষি। সেরকম দেশের মানুষ নোবেল পেতে পারে, একথা তাঁরা ভাবতেও পারেনি। প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল পাওয়ার পর, যেদিন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ছবি ছাপা হলো – লম্বা বেণী করা চুল, এক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, উন্নত নাক, দৃষ্টিটা যেন কোন সুদূরে। সারা ইউরোপের মানুষ ভাবলো, হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো, এই তো সেই ভারতীয় ঋষি। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ী কাব্য ‘সং অফারিংস’ পড়লেন। এর প্রতিটা লাইনেই তো কেমন একটা ঘোর, একটা মরমী ভাবনা। অজানা কোন শক্তির প্রতি ভালোবাসার দর্শনে গাঁথা। তাহলে এই সেই ঋষি। কলকাতার রাজপ্রাসাদে জন্ম নিলেও, অবয়ব আর আধ্যাত্মিক লেখনী মিলে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে হয়ে উঠলো তপোবনের সাধু। এই সাধুর আছে এক অদ্ভুত সম্মোহন। এলবার্টও সম্মোহিত হলেন। কবির সাথে দেখা করার ইচ্ছা তাঁর সেদিন থেকেই।

পাইপে ধুঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বারান্দায় গেলেন এলবার্ট। সেক্রেটারিকে ডেকে বললেন, ‘শোন, টেগোর আসছেন জার্মানিতে। আমি তাঁকে বাসায় নিমন্ত্রণ করতে চাই। তুমি ব্যবস্থা কর। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ তিনি আসবেন। সেই সময় আমার অন্য কোন প্রোগ্রাম থাকলে তা পিছিয়ে দাও।’
সেক্রেটারিকে বিদায় দিয়ে তিনি বেহালা নিয়ে বসলেন। তাঁর ঘর থেকে ভেসে এলো এক মমতামাখা করুণ সুর। কে বলবে এই পাগল বেহালা বাদকই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ঐ একই আঙ্গুলে যেমন সংগীতের সুর বের হয় আবার তেমনি বিজ্ঞানের সবচেয়ে কঠিন সমীকরণ তৈরি হয়।
আইনস্টাইনের সেক্রেটারি ভীষণ কাজের লোক। তিনি অতি সত্ত্বর বার্লিনের ব্রিটিশ এম্বাসিতে যোগাযোগ করলেন। তারাই রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসূচী তৈরি করে। তাদের অনুমতি নিয়ে টেলিগ্রাম করলেন শান্তিনিকেতনে কবির সেক্রেটারি অমিয় চক্রবর্তীকে। সময়মত আইনস্টাইনের নিমন্ত্রণও পৌছে গেলো রবীন্দ্রনাথের কাছে।
উত্তরে অমিয় চক্রবর্তী জানালেন, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আনন্দের সাথে বিজ্ঞানীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তবে সমস্যা হলো কবির ভ্রমণসূচী ঠিক হয়ে গেছে। এখন সময় বের করা প্রায় অসম্ভব। তবে ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলবেলা জার্মানির সংস্কৃতি মন্ত্রী মিস্টার বেকার কবির সম্মানে একটি চা-চক্রের আয়োজন করবেন। সেই চা-চক্রের পর সন্ধ্যায় সময় করতে চেষ্টা করবেন কবি।

টেলিগ্রাম পড়ে বিজ্ঞানী কিছুক্ষণ ভাবলেন। সেক্রেটারিকে বললেন, বেশ তো। আমিও মন্ত্রী বেকারের চা-চক্রে নিমন্ত্রিত। তাহলে সেখান থেকে আমি সরাসরি কবিকে আমার বাসায় নিয়ে আসব।
সেক্রেটারি নিচু স্বরে বললেন, অতোটা কি ভালো হবে! আপনি বাসায় থাকবেন, আমি গিয়ে তাঁদের নিয়ে আসব।
এলবার্ট বুঝলেন, কবিকে অতো গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি তাঁর সেক্রেটারী ভালো চোখে দেখছেন না। জাতি হিসেবে জার্মানরা বিশ্রী রকমের নাক উঁচু। তবু তাঁকে প্রশয় দিলেন বিজ্ঞানী। তিনি হেসে বললেন, ঠিক আছে, তাই করো।

১৯২৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।
আইনস্টাইন আর রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন আইনস্টাইন ভিলার বারান্দায়।
সেপ্টেম্বরের এই সময় জার্মানিতে মাত্র শীত পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা এখনও জেঁকে বসেনি। কিন্তু এই ঠাণ্ডায়ই কবি বেশ জুবুথুবু। রবীন্দ্রনাথ অতো কাছে বসে আছেন, বিশ্বাস হচ্ছে না আইনস্টাইনের। এতোদিন দূর থেকে যাকে ঋষি মনে করতেন, সামনে থেকে দেখে তাঁকে আরও বেশি ঋষি মনে হচ্ছে। হুম, লোকটার মাঝে সম্মোহন আছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তাঁর। শুধু একটাই সমস্যা – কবির সামনে তিনি পাইপ টানতে পারছেন না। বেশিক্ষণ পাইপ ছাড়া থাকা বিজ্ঞানীর জন্য অস্বস্তির। কিন্তু এই ঋষি কবির কোন ধরনের নেশা নেই – এটা তিনি ভালোই জানেন। তাই বয়োজেষ্ঠ্য কবির সম্মানে তিনি তাঁর সামনে ধূমপান করবেন না, আর তরল পানীয়ের তো প্রশ্নই আসে না।
হালকা কথা বার্তা চলছে। কবি কথা বলছেন কম। যেন সুদূরে তাকিয়ে আছেন। বিজ্ঞানী ভাবছেন কি বলবেন।
হঠাৎ কবি বললেন, এলবার্ট, আমি কিন্তু তোমার বেহালার কথা জানি। আমাকে বেহেলা শুনাবে না?
অবাক হলেন এলবার্ট। তার বেহালার খবর কবি জানেন! তিনি বললেন,
– আপনি বেহালা পছন্দ করেন?
– করি মানে? পিয়ানো আমাকে বিস্মিত করে, আর বেহালা আমাকে দেয় আনন্দ। মনের গহিনের কথা শুনতে বেহালার মত সুর আর কিছুতে হয় না। শোনাও তোমার বেহালা।
সেক্রেটারি বেহালা নিয়ে আসলো। এলবার্ট ধরলেন বেহালা।
কবি তন্ময় হয়ে শুনছেন। বিজ্ঞানী হয়েও এলবার্ট এতো ভালো বাজান! বিস্মিত হলেন কবি।

এলবার্টের অনেক ইচ্ছা ছিলো আজ কবির সাথে দর্শন আর বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু এখন আর সে সময় নেই। কবি কথা দিলেন। সামনের বার জার্মানি আসলে অবশ্যই তিনি বিজ্ঞানীর আতিথ্য নিবেন।
আইনস্টাইন স্বর নিচু করে বললেন, কবি আমি একটা সামার হাউজ কিনব। একটা বাড়ি পছন্দ হয়েছে। বার্লিন থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে পটসডাম শহরের পাশে কাপুথ নামের একটা গ্রামে। সেখানেই গ্রীষ্মকাল কাটাব। আমি সেখানে আপনাকে আমন্ত্রণ করতে চাই।

খুশি হলেন কবি। এলবার্টের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমার সামার হাউজে অবশ্যই যাব। প্রকৃতির কোলে বসে তোমার বেহালা শুনব। শুধু তোমার সাথে দেখা করার জন্য হলেও আমি আবার জার্মানি আসব।

কবি বিদায় নিলেন। তিনি এলবার্টকে পছন্দ করেছেন। এমন বিনয়ী আর সজ্জন বিজ্ঞানী তিনি কম দেখেছেন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তাঁর মধ্যে কোথায় যেন একটা কবি কবি ভাব আছে। একটা শিল্পী লুকিয়ে আছে তার খটমট বিজ্ঞান চর্চার আড়ালে। আবার জার্মানি আসলে তিনি নিজে থেকেই এলবার্টের সাথে দেখা করবেন। (সুজন দেবনাথ দাদার টাইমলাইন থেকে)

No comments