Search Here

Breaking News

যেভাবে উন্নতির শিখরে আরোহণ করা যায়

খুব ঠাণ্ডার কারণে মোটা জ্যাকেট পরে ক্লাসে যেতে হয়। প্রফেসর ক্লাসে প্রবেশ করেই এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার জ্যাকেট টি কোন দেশে তৈরী? ছাত্রটি ঝটপট জ্যাকেটের গায়ে লাগানো ল্যাবেল দেখে বলল, "বাংলাদেশ।" কিছুটা গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। কিন্তু আমার আনন্দে পানি ঢেলে দিয়ে প্রফেসর বললেন, "না বাংলাদেশে নয়!" ছাত্রটি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, "আমি তো ট্যাগ দেখেই বলছি!" প্রফেসর পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "আই-ফোনের গায়ে লিখা রয়েছে - 'মেইড ইন চায়না', তাই বলে আই-ফোন কি চীনে তৈরী?" সবাই বলল, "না।" তিনি বললেন আই-ফোন যেমন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া 'সিলিকন ভ্যালি' হতে প্রযুক্তি নিয়ে এসে চীনে এসেম্বল (assemble) হয়ে 'মেইড ইন চায়না' সীল নিয়ে বাজারে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এক একটা উপাদান নিয়ে এই জ্যাকেট বাংলাদেশে সেলাই হয়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ল্যাবেল নিয়ে বের হচ্ছে। এগুলো কোন একক দেশের প্রোডাক্ট নয়, বরং বলতে পারো 'গ্লোবাল প্রোডাক্ট'। তার পর তিনি বললেন বাংলাদেশী কেউ আছ? আছি বলার পর বললেন, "আমি কি সঠিক বলেছি?" আমার সম্মতি না দেয়ার তো কোন যুক্তি নাই।

হ্যাঁ, আসলেই তাই। অধিকাংশ পণ্যই এখন 'গ্লোবাল প্রোডাক্ট'। আর যিনি এর পথ প্রদর্শক তিনি আধুনিক অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ বৈ আর কেউ নন। ১৭৭৬ সালে তাঁর বই 'The Wealth of Nations' প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি অর্থনীতির মৌলিক  ধারণাগুলোর সাথে সাথে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে নিয়ে এসেছিলেন - একটি 'শ্রম বিভাগ', অন্যটি আন্তর্জাতিক-বাণিজ্য। তাঁর দেখানো পথ ধরেই 'বিশ্ব অর্থনীতি' এবং 'বিশ্ব-বাণিজ্য' আজ দানবীয় (gigantic) রূপ লাভ করেছে। কোন দেশের তৈরী চাকা, কোন দেশে ডানা,আর অন্য কোন দেশের তৈরী ইঞ্জিন জোড়া লেগে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দৈত্যাকৃতির 'এয়ারবাস'; সকাল বেলায় আফ্রিকার ক্ষেত হতে উঠানো সবজি বিকাল বেলায়ই এসে পৌঁছাচ্ছে ইউরোপে।

আন্তর্জাতিক-বাণিজ্যের পথ ধরেই 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' বাণিজ্যের পসারা সাজিয়ে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে সারা বিশ্বকে বহুকাল শাসন ও শোষণ করেছিল। মুক্ত বাণিজ্যের কথা বললেও বিশ্ব বাণিজ্য আজ মোটেও মুক্ত নয়। মানুষের গড় আয় বাড়লেও ধন-বৈষম্য বেড়েছে বহুগুণ। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ব্যবসার নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে।

কিন্তু এ দায় এডাম স্মিথের নয় - তিনি অর্থনীতি শেখানোর আগে নীতি-নৈতিকতা শেখাতে চেয়েছিলেন। সে জন্যই তিনি 'The Wealth of Nations' প্রকাশের বহু আগে ১৭৫৯ সালে তাঁর ততোধিক মূল্যবান বই 'The Theory of Moral Sentiments' প্রকাশ করেছিলেন। যে বইটিতে তিনি সবিস্তারে উৎপাদন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় তথা তাঁর পরবর্তী কর্মগুলোর (মূলতঃ 'The Wealth of Nations'-এর) নৈতিক ভিত্তি বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যের বিষয় হল - সারা বিশ্বের 'Business School' সমূহে তাঁর 'The Wealth of Nations' গুরুত্বের সহিত পড়ানো হলেও  'The Theory of Moral Sentiments'-এর নামও নেয়া হয় না। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আজ নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই।

সে যাই হোক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছাড়া অন্য কোন বিকল্প এখনও পর্যন্ত নাই। ইউরোপ-আমেরিকা এ পথ ধরে বহু আগেই সমৃদ্ধি লাভ করেছে। হালে বহু দেশ যে উন্নতি লাভ করছে তার মূলেও রয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। হংকং-এর কথা ধরা যাক - এই দেশটির সত্তরের দশকেও কিছুই ছিল না। শুধু ছিল একটি বন্দর এবং অধিক পরিশ্রমী কিছু জনগণ। আর এ দুই নিয়েই যিনি আধুনিক সমৃদ্ধশালী হংকং নির্মাণ করেছিলেন তিনি হংকং-এর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হাওয়া তো দূরে থাক, তিনি হংকংএর নাগরিকই ছিলেন না। তিনি স্কটিশ বংশোদ্ভূত  ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্ট John James Cowperthwaite এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ হংকং-এর  ফাইন্যান্স সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন। John James Cowperthwaite ছিলেন এডাম স্মিথের কঠিন অনুসারী। তিনি এই সময়ে এক দিকে 'The Wealth of Nations' অনুসরণে হংকংএ প্রবর্তন করেছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতি। অন্যদিকে একই সাথে 'The Theory of Moral Sentiments' অনুসরণে peace, easy taxes, এবং tolerable administration of justice নিশ্চিত করে হংকংকে দিয়েছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের নৈতিক ভিত্তি। [“Little else is requisite to carry a state to the highest degree of opulence from the lowest barbarism but peace, easy taxes, and a tolerable administration of justice: all the rest being brought about by the natural course of things.” - Adam Smith, The Theory of Moral Sentiments] আজ হংকং এতটাই উন্নত যে, তাঁর নিজ দেশ যুক্তরাজ্যের চেয়েও হংকংএর মাথা পিছু আয় অনেক বেশি।

অতি সম্প্রতি সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে আজ চীন আমেরিকাকে পিছনে ফেলে সর্ব বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। কনফুসিয়াসের দেশের ছেলে-মেয়েরা তাঁর বাণী অনুসরণ করে বিদ্যার্জন ও নিজ দেশের উন্নয়নে তা প্রয়োগের জন্য ইংল্যান্ড-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিজগিজ করছে। [ "The essence of knowledge is, having it, to apply it; not having it, to confess your ignorance." - Confucius]

গান্ধীবাদী মিশ্র অর্থনীতি ছেড়ে আজ ভারত পূর্ণ মুক্ত বাজার অনুসরণ করে চীনকে পিছনে ধাওয়া করছে (সূত্র: অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি - আকবর আলি খান)।

আমরা ও যথেষ্ট উন্নতি করেছি। Allen Ginsberg এর 'September on Jessore Road' কবিতায় পাকিস্তানীদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালীন ও তার পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের দুঃখ, দারিদ্র্য আর দুর্দশার যে চিত্র ফুটে উঠেছিল তা আমরা আজ অনেক দূর ফেলে এসেছি। এখন দরকার আমাদের চীনের মত একটা Big-push এবং গার্মেন্টস শিল্পের পাশাপাশি প্রযুক্তি নির্ভর কয়েকটি শিল্প দাঁড় করানো। এই বিশাল জনসংখ্যা আমাদের দায় নয় বরং সম্পদ । আমাদের সামনে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ চীন। কারণ - একজন ব্যক্তির পেট একটি আর হাত হলো দুইটি। এই দু’টি হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরের জন্য দরকার কর্মমুখী প্রযুক্তিগত শিক্ষা আর এদের কর্ম সংস্থানের জন্য শ'খানেক উদ্যোক্তা (entrepreneurs)।

ভারী ভারী সার্টিফিকেট আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের শিক্ষাকে সাজাতে হবে নৈপুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে।

 ["প্রাচীন বিশ্বে জ্ঞান (knowledge) এবং নৈপুণ্য (techne) এর মধ্যে তফাৎ করা হতো। জ্ঞানের মতো নৈপুণ্যও অর্জন করতে হয়। কিন্তু নৈপুণ্য জ্ঞান নয়। নৈপুণ্য সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব। একই নৈপুণ্য সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় - ভিন্ন ভিন্ন পেশার চাহিদা অনুসারে নৈপুণ্য গড়ে ওঠে। জ্ঞানের সাথে জড়িত আছে মূল্যবোধ আর জীবন-জিজ্ঞাসা। কিন্তু নৈপুণ্য মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ। দার্শনিকদের কাছে নৈপুণ্য হেয় মনে হলেও, আধুনিক বাজারে নৈপুণ্যের চাহিদা আছে, জ্ঞানের নেই। তাই আধুনিক বিশ্বে নৈপুণ্য জ্ঞানের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। ................. জ্ঞানের সাথে অর্থের সম্পর্ক ক্ষীণ, নৈপুণ্যের সাথে আয়ের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। বিদ্যার আধ্যাত্মিক ভিত্তি যত দুর্বল হচ্ছে ততই তার বস্তুবাদী ভিত্তি হয়ে উঠছে সুদৃঢ়।" -- আকবর আলি খান (পরার্থপরতার অর্থনীতি)]

আর, কেনা-বেচা নির্ভর ব্যবসায়ী নয়, বরং প্ৰয়োজন কিছু প্রকৃত উদ্যোক্তা। যাঁরা উদ্ভাবন (innovation) করবে আর তাঁদের উদ্ভাবনকে বাজারজাত করবে। উদ্ভাবন বলতে শুধু বিশাল বিশাল groundbreaking আবিষ্কার বুঝায় না। বরং ব্যবসায় উদ্ভাবন দু' ধরণের - পণ্য উদ্ভাব (product innovation) এবং প্রক্রিয়া উদ্ভাবন (process innovation)। পণ্য উদ্ভাব আমাদের মত দেশে কঠিন হলেও প্রক্রিয়া উদ্ভাবন খুব সহজে সম্ভব। যেমনঃ কেউ রাস্তার পাশে বসে ভাঁপা পিঠা বিক্রি করে প্রতি পিস্ ৫ টাকা দরে। আপনি এই একই ভাঁপা পিঠা ঘরে তৈরী করে সুন্দর রঙিন প্যাকেট করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে প্রতি পিস্ ১৫ টাকা করে পেতে পারেন। - এটি process  ইনোভেশনের একটি উদাহরণ মাত্র।

আমরা চীনের মত আমেরিকার প্রযুক্তি পণ্যগুলো আমাদের দেশে এসেম্বলিং করে লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থা করতে পারি। শুধু দরকার একটা ভাল পরিকল্পনার। অন্যদিকে যুবকেরা চাকুরীর পিছনে না ঘুরে Amazon, eBay, Alibaba ইত্যাদি টাইপের Internet-based retailer / E-commerce company এর সাথে যুক্ত হয়ে প্রচুর আয় করতে পারে। আগে বলা হত লেনদেনের সহজ গেটওয়ে নেই, কিন্তু এখন দেশে PayPal এসেছে তাই আর অসুবিধা থাকার কথা নয়। - WE SHALL OVERCOME

লেখকঃ জয়নাল আবদিন
এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের সদস্য।
বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ব্যাডফোর্ডে অর্থনীতিতে পিএইচডি গবেষণারত।

No comments